রবিবার, ৬ই অক্টোবর ২০২৪, ২০শে আশ্বিন ১৪৩১ | ই-পেপার
ব্রেকিং নিউজ:
  • সারাদেশে জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আগ্রহী হলে আপনার সিভি ই-মেইল করতে পারেন। ই-মেইল daajkaal@gmail.com
সংবাদ শিরোনাম:
  • মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য মাল্টিপল ভিসা দেওয়ার আহ্বান ড. ইউনূসের
  • ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতির শোক
  • সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল হবে: আসিফ নজরুল
  • বৈরী আবহাওয়া, উপকূলীয় অঞ্চলে নৌযান চলাচল বন্ধ
  • শহীদ পরিবারের পক্ষে আজ মামলা করবে নাগরিক কমিটি
  • ৪ বন্দরে ৩ নম্বর সতর্কসংকেত
  • সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা কামালসহ গ্রেপ্তার ৪
  • চুক্তিতে খাদ্য সচিব হলেন ইলাহী দাদ খান
  • সুপারশপে আজ থেকে পলিথিন ব্যাগ বন্ধ
  • ১৭ উপসচিবকে শাস্তির সুপারিশ

ভেবেছিলাম ধৌলাগিরির সেই রাতই শেষ রাত

বসন্ত সিংহরায়

প্রকাশিত:
১২ জুন ২০২৩, ১৭:২৮

 

উচ্চতা ৭৮০০ মিটার। তাপমাত্রা তখন মাইনাস ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সঙ্গে আনা খাবার, জল সব শেষ। সিলিন্ডারের অক্সিজেনও ফুরিয়েছে ইতিমধ্যেই। আমার সঙ্গী দেবাশিস ও শেরপারা একটু আগেই নেমে গিয়েছে নীচের দিকে। অথচ আমার আর এক পা-ও চলার ক্ষমতা নেই। ওরাও ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত— কী করেই বা আমায় টেনে তুলবে! সে রাতে বিশ্বের সপ্তম উচ্চতম শৃঙ্গ ধৌলাগিরির বুকে খোলা আকাশের নীচে শুয়ে এক রকম নিশ্চিত হয়েই গিয়েছিলাম যে, আমি আর বাঁচব না।

 

২০১০ সালে দেবাশিস বিশ্বাসের সঙ্গে জুটি বেঁধে প্রথম অসামরিক বাঙালি হিসেবে সফল এভারেস্ট অভিযান করেছিলাম আমরা। এর পরে দু’জনের এক সঙ্গে পর পর আট হাজারি শৃঙ্গে অভিযান— ২০১১-এ কাঞ্চনজঙ্ঘা, ২০১২ তে অন্নপূর্ণা-এক। প্রতি বারেই সাফল্যের স্বাদ পাচ্ছি। ২০১৩ সালে লক্ষ্য স্থির করলাম ধৌলাগিরি (৮১৬৭ মিটার)। তখন আমার বয়স ৫১-৫২ বছর। তিন শেরপাকে সঙ্গে নিয়ে এপ্রিলে শুরু হল আমাদের অভিযান। আবহাওয়া দেখেটেখে হিসাব কষে স্থির হল, ২২ মে ক্যাম্প-৩ থেকেই ‘সামিট পুশ’-এ বেরোব আমরা।

পরিকল্পনা মতো রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ বেরোই আমরা। প্রথমে আবহাওয়া ভাল থাকলেও আস্তে আস্তে হাওয়ার গতি বাড়তে থাকে। আমাদের সামনে ছিলেন দুই স্প্যানিশ পর্বতারোহী ও তাঁদের এক শেরপা। ছিলেন এক জাপানি মহিলা ও তাঁর দুই শেরপাও। সকলেই সামনে-পিছনে ছিলাম। সারা দিন পথ চলে দুপুর তিনটে-সাড়ে তিনটে নাগাদ যখন সামিট থেকে মাত্র ১০০ মিটার মতো দূরে, হঠাৎ দেখলাম সামনের ওই স্প্যানিশ আরোহীদের সঙ্গে থাকা কেশব শেরপা আচমকা পা হড়কালেন। তাঁর সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা আরোহী জুয়ানজো গারা সেই টানে পড়ে গেলেন। দু’জনে গড়িয়ে নেমে গেলেন কিছু দূর। তবে এক জায়গায় বরফে আটকে গেলেন তাঁরা। একটু পরে উঠেও বসলেন কেশব। চোখের সামনে এই দুর্ঘটনা দেখে আর সামনে এগোইনি আমরা। বুঝলাম, এ বারের মতো সামিট অধরা রেখেই ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে।

এ দিকে সারা রাত-দিন পথ চলে আমাদের কারও শরীরই আর তখন বইছে না। সঙ্গে জল, খাবার কিছুই আর নেই। অক্সিজেনও শেষ। রাতে গগলস খুলে হাঁটছিল বলে চোখে তখন প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না দেবাশিস। এক সময়ে ও বসে পড়ল, আর পারছে না। ওর মনোবল বাড়াতে আমিও পাশে বসে পড়লাম। গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। এর পরে উঠতে গিয়ে দেখি, আর দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই আমার। এক পা এগোনো তো অনেক দূরের কথা!

 

এক সময়ে আমাকে রেখে ওরা আস্তে আস্তে নামতে শুরু করল। বুঝতে পারছিলাম সমূহ বিপদ সামনে, এ ভাবে সারা রাত খোলা আকাশের নীচে পড়ে থাকলে তার পরিণতি কী, তা হাড়ে হাড়ে জানি। কিন্তু শরীরে এক কণা ক্ষমতাও আর অবশিষ্ট নেই।

৭৮০০ মিটার উচ্চতায় সেই রাতই জীবনের শেষ রাত, প্রথমে এমনটাই ভেবে নিয়েছিলাম। বাড়ির কথা ভেবে মনটাও খারাপ হয়ে গেল খুব। কিন্তু মিনিট দশেক পরে মনে বল ফিরে পেলাম। ভাবলাম, আমার ভাল পোশাক রয়েছে, ঠান্ডায় সহজে কাবু হব না। কাল সকালে শেরপারা নিশ্চয়ই আসবে আমায় উদ্ধার করতে। আসলে এই সব বিপদের সময়ে এক জন পর্বতারোহী কী ভাববেন বা কী করবেন, তা তাঁর মানসিকতা ও অভিজ্ঞতার উপরে নির্ভর করে। সেই ১৯৯০ সাল থেকে পাহাড়ে যাচ্ছি। একের পর এক অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া, দলনেতা হিসেবে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া— এ সবের ফলেই হয়তো জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে আমি মনোবল হারাইনি, ইতিবাচক মানসিকতা বজায় রাখতে পেরেছি।

ধৌলাগিরির বুকে সে দিন সকলেই কমবেশি বিপদের মুখে পড়ি। সামিটের কাছে ওই দুর্ঘটনার পরে গোড়ালি ভেঙে গিয়ে আর নীচে নামার ক্ষমতা ছিল না জুয়ানজোর। দিন তিনেক আট হাজার মিটারের উপরেই পড়ে ছিলেন। তবে তাঁর সঙ্গ ছাড়েননি কেশব শেরপা। আজকালকার দিনে এমন ঘটনা বিরল বইকি! তিন দিন পরে যখন তাঁর কাছে পৌঁছয় উদ্ধারকারী দল, তত ক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। মারা গিয়েছেন জুয়ানজো। তবে উদ্ধার করে নীচে নামানো হয়েছিল কেশবকে। বিপদ ছাড়েনি জাপানি মহিলাকেও। সে রাতে শুয়ে শুয়েই দেখেছিলাম, পথ হারিয়ে ওই উচ্চতায় নীচে নামার চেষ্টা করছেন তিনি। তাঁকে টর্চের আলো ফেলে পথের দিশা দেখানোর চেষ্টাও করেছিলাম। এক সময়ে সেই মহিলার গলা শুনেছি, ‘হেল্প হেল্প’ বলে আর্তনাদ করতে করতে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছেন। আমার মতো ওঁরও অক্সিজেন ফুরিয়ে গিয়েছিল। সে রাতে ধৌলাগিরি থেকে আর ফেরা হয়নি তাঁর। এখন ভাবি, ধৌলাগিরির সেই অভিশপ্ত রাতে একমাত্র আমিই হয়তো ভাগ্যবান ছিলাম।

 

পড়ে থাকতে থাকতে এক সময়ে আমার আর জ্ঞান ছিল না। সকালে চোখ মেলে দেখি ভোরের আলো ফুটছে। প্রথমেই মনে হল, এখনও বেঁচে আছি! আবার জ্ঞান হারাই। এর পরে যখন জ্ঞান ফিরল, দেখি দিনের আলোয় ঝকঝক করছে আকাশ। এক সময়ে দেখি, কে যেন আস্তে আস্তে উঠে আসছে। কাছে আসতে বুঝলাম, এ আমারই দলের এক শেরপা। আমি যে এখনও বেঁচে আছি, তা বোঝাতে হাত উপরে তুলে নাড়াতে লাগলাম। তবে ওই শেরপা বাংলা, হিন্দি কিছুই প্রায় বুঝত না।ও এল, সব দেখেটেখে খালি অক্সিজেন সিলিন্ডার, দেবাশিসের রুকস্যাক এই সব নিয়ে নীচে চলে গেল! আমাকে বিশেষ পাত্তা দিল না। সম্ভবত রাতে ক্যাম্প অবধি পৌঁছয়নি ও, নীচের দিকে কোনও পাথরের খাঁজে রয়ে গিয়েছিল।

এর পরে দুপুরের দিকে এক সময়ে উঠে এল দাওয়া ওয়াংচু শেরপা। আমায় অক্সিজেন দিল, জল খাওয়াল। জল মানে জমে যাওয়া বরফ, কড়মড় করে চিবিয়ে খেলাম। তাতে কিছুটা ধাতস্থ হলাম। এর পরে শুরু হল আমায় নীচে নামানোর পালা। কখনও পিঠে করে, কখনও টেনে, কখনও ঘষটে ঘষটে প্রায় ৬০০ মিটার নীচে নামিয়ে আনে আমায়। আজও ভাবি, কী করে কাজটা করেছিল ও! এক সময়ে এসে পৌঁছলাম ক্যাম্প-৩’এর উপরে একটি ফাঁকা তাঁবুতে। ওটা সেই জাপানি মহিলার তাঁবু। সেখানে তখন দেবাশিস, পেম্বা-সহ বাকি শেরপারা ছিল। ওরাই শুশ্রূষা শুরু করল আমার। তত ক্ষণে আমি ভুল বকতে শুরু করেছি, মাথা কাজ করছে না।

পর দিন আরও ২০০ মিটার টেনেহিঁচড়ে আমাকে নামায় ওরা। ক্যাম্প-৩’এ পৌঁছে ম্যাট্রেস দিয়ে বেঁধে ফেলে আমাকে। এক সময়ে সেখানে দেবদূতের মতো এসে হাজির হয় একটি হেলিকপ্টার। আদতে জুয়ানজোকে উদ্ধার করতে এসেছিল সেটি। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছতে পারেনি। একই সঙ্গে আমাকেও উদ্ধার করে নিয়ে যাবে বলে কথা হয়ে ছিল। তাই লং লাইন রোপ পদ্ধতিতে দড়ি দিয়ে আমায় ঝুলিয়েই নীচে বেসক্যাম্পে নিয়ে চলে যায়। পরে জেনেছিলাম, আমার নিখোঁজের খবরে সমতলে সরকারি তরফে তৎপরতা শুরু হয়েছিল। তাই তড়িঘড়ি আমাকে নিতেও এসেছিল হেলিকপ্টার। আর ছিল বহু মানুষের প্রার্থনা আর ভালবাসা— আমি নিশ্চিত, তার জোরেই হাড় হিম করা সেই রাত পেরিয়ে আসতে পেরেছি।

১৭ মে দিনটা আমাদের এভারেস্ট আরোহণের বর্ষপূর্তি। সেই দিনেই চন্দননগরের পিয়ালি বসাকের মাকালুর শীর্ষ ছোঁয়ার খবরে উৎফুল্ল হয়েছি। প্রবল আর্থিক প্রতিকূলতাকে পিছনে ফেলে, স্বাভাবিকের তুলনায় কম ওজনের মেয়েটির এই সাফল্য তারিফযোগ্য। ছ’টা আট হাজারি শৃঙ্গ জয় কি মুখের কথা না কি! আর যে ভাবে ও ফিরে এসেছে, সেই অভিজ্ঞতাই তো আমায় বার বার ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ২০১৩ সালে ধৌলাগিরির সেই রাতে।

 

আজকাল এক সঙ্গে একাধিক শৃঙ্গাভিযান দেশি-বিদেশি অনেকেই করছেন। ঘরের মেয়ে পিয়ালি থেকে হিমাচলের বলজিৎ কৌর বানরওয়ের ক্রিস্টিলা হ্যারিলা বা নেপালের নির্মল পূরজা, পর পর সামিট করাটাই এখন ‘ট্রেন্ড’। তবে আমাদের সময়ে কিন্তু এ রকম ভাবে ভাবতে পারতাম না। আবার পাহাড় থেকে বেশি দিন দূরেও থাকতে পারতাম না। পাহাড়ের টান বড় অমোঘ। তাই তো ধৌলাগিরিতে ফ্রস্টবাইট হয়ে পায়ের তিনটে আঙুল হারিয়ে, মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসার পরেও পাহাড়ের টান এড়াতে পারিনি। সাসের কাঙ্গরি ৪-এ বহু দিনের পাহাড়-সঙ্গী পেম্বা শেরপার আচমকা চলে যাওয়াও পাহাড়বিমুখ করতে পারেনি আমায়। ওরাও পারবে না। যত ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাই হোক না কেন, সব বাধা পেরিয়ে কোনও না কোনও দিন আবার পাহাড়ের কাছেই ফিরবে ওরা। এ আমার স্থির বিশ্বাস।

অনুলিখন: স্বাতী মল্লিক


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর