বৃহঃস্পতিবার, ৫ই ডিসেম্বর ২০২৪, ২১শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | ই-পেপার
ব্রেকিং নিউজ:
  • সারাদেশে জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আগ্রহী হলে আপনার সিভি ই-মেইল করতে পারেন। ই-মেইল daajkaal@gmail.com
সংবাদ শিরোনাম:
  • বাংলাদেশে নয় ভারতেই শান্তিরক্ষা বাহিনী পাঠানো উচিত
  • পলাতক ৭০০ বন্দি এখনও অধরা
  • ইসি সচিবালয়ের সচিব শফিউল আজিমকে ওএসডি
  • পিলখানা হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ উদ্‌ঘাটনে স্বাধীন কমিশন গঠন
  • আবারও পুলিশে বড় রদবদল
  • সচিবালয়ে কর্মচারীদের মহাসমাবেশ স্থগিত
  • কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল শুরু
  • ঢাকার বাতাস আজ ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’
  • দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াবে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া
  • আদালতে আত্মসমর্পণ করলেন সেই তাপসী তাবাসসুম

দুবাইয়ের সঙ্গে আরো জড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি

ডেক্স রিপোর্ট

প্রকাশিত:
১১ জুন ২০২৩, ১৭:১৭

চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশটি এখন বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের দ্বিতীয় বৃহৎ উৎসও। বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রেও সামনে আসছে আরব আমিরাতের নাম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশে ৫৫৪ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এর মধ্যে একক দেশ হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছে ৮৬ কোটি ৭৩ লাখ ডলার, যা মোট রেমিট্যান্সের ১৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। একই সময়ে সৌদি আরব থেকে ৮৫ কোটি ৩৭ লাখ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৮৩ কোটি ৪৫ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। সে হিসাবে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে রেমিট্যান্স আহরণের উৎস হিসেবে শীর্ষস্থানে ছিল আরব আমিরাত। ২০২২ সালের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে আরব আমিরাত থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে ৯২ শতাংশের বেশি। একই সময়ে প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স কমেছে ১৯ শতাংশ।

চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪০৮ কোটি বা ১৪ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলার। আর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি মিলিয়ে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার। বেসরকারি খাতে এ বিদেশী ঋণের অন্যতম উৎস হলো ইউএই। দেশটির বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ২৩২ কোটি ৯৪ লাখ ডলারের ঋণ এসেছে। বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রে ইউএইর নাম রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। এক্ষেত্রে প্রথম স্থানটি সিঙ্গাপুরের। সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ এসেছে ৩১২ কোটি ৫২ লাখ ডলার।

দেশের অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই এখন দুবাইকে বেছে নিয়েছে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের কেন্দ্র হিসেবে। ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ থেকে অনেক ব্যবসায়ী এখন দুবাইয়ে অনানুষ্ঠানিক অফিস খুলে সেখান থেকে ব্যবসা করছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। অতীতে দেশের বিত্তবানদের কাছে দুবাইয়ের আকর্ষণ ছিল নিছক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ আকর্ষণ রূপ নিয়েছে প্রকাশ্য ও গোপন লগ্নির কেন্দ্র হিসেবে। আকর্ষণীয় মুনাফার খোঁজে রিয়েল এস্টেট ছাড়াও অন্যান্য ব্যবসায় নাম লেখাচ্ছেন তারা। আরব আমিরাতও এখন যেকোনোভাবে হোক বিদেশ থেকে পুঁজির প্রবাহ বাড়াতে উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। এজন্য বিদেশী ধনীদের স্থানান্তরিত হতে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধাও দেয়া হচ্ছে।

কয়েক দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশ্যে-গোপনে বিপুল পরিমাণ মূলধন স্থানান্তরিত হচ্ছে দুবাইয়ে। এ অর্থ পুনর্বিনিয়োগে ফুলেফেঁপে উঠছে দুবাইয়ের আর্থিক, ভূসম্পত্তি, আবাসনসহ (রিয়েল এস্টেট) বিভিন্ন খাত। বিত্তবান বিদেশীদের আকৃষ্ট করতে ২০১৯ সালে গোল্ডেন ভিসা চালু করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। বাংলাদেশী ধনিক শ্রেণীর অনেকেই আমিরাতের দেয়া এ সুযোগ লুফে নিচ্ছেন। ব্যাংক পরিচালক, ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ও মাঝারি স্তরের কর্মকর্তা, পোশাক ব্যবসায়ী, রেল ও সড়কের সামনের সারির ঠিকাদারসহ দেশের বড় ও মাঝারি এমন অনেক পুঁজিপতিই এখন আমিরাতের গোল্ডেন ভিসাধারী। আর দুবাইয়ের এ গোল্ড কার্ডধারী ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে দেশ থেকে বিপুল অংকের পুঁজি পাচার হয়েছে বলে সন্দেহ সংশ্লিষ্টদের।

অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সিআর আবরার মনে করেন, দুবাইয়ে বাংলাদেশীদের সম্পদ ফুলেফেঁপে ওঠার সংবাদ উদ্বেগের। তিনি বলেন, ‘নাগরিক হিসেবে আমরা বিদেশে পড়ালেখা করতে যাওয়া সন্তানদের টাকা পাঠাতে গেলেও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু আমরা দেখছি, আরব আমিরাতসহ বিশ্বের অনেক দেশে বাংলাদেশীদের সম্পদ ফুলেফেঁপে উঠছে। আমিরাত থেকে যে অর্থ বাংলাদেশে আসছে, সেটি আসছে বৈধ চ্যানেলে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যে অর্থ চলে যাচ্ছে, সেটি অবৈধ চ্যানেলে যাচ্ছে। এ ধরনের লেনদেন সুস্থ অর্থনৈতিক কাঠামো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। নাগরিক হিসেবে এটি আমাদের উদ্বিগ্ন করে।’

সিআর আবরার বলেন, ‘দেশে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমেরিকা-ইউরোপ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। এটি দেশের জন্য একটি ক্রান্তিকাল। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দুবাই বাংলাদেশীদের অর্থ পাচারের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।’

২০২০ সালে করোনার মধ্যেই দেশের নির্মাণ খাতের ঠিকাদারির সঙ্গে যুক্ত একজন ব্যবসায়ী দুবাই চলে যান। এরপর থেকে তিনি সেখানেই বসবাস করছেন। দেশের ব্যবসা থেকে উপার্জিত মুনাফা প্রতিনিয়ত দুবাইয়ে স্থানান্তর করছেন তিনি। এরই মধ্যে তিনি দুবাইয়ের আবাসন ও নির্মাণ খাতে বড় ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে দুবাইয়ে বড় অংকের বিনিয়োগ করা দেশের একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘‌ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে এতদিন সিঙ্গাপুর ও হংকং বাংলাদেশীদের জন্য সুবিধাজনক ছিল। কিন্তু দেশ দুটির করপোরেট সুশাসন ও রীতিনীতি বাংলাদেশী ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালীদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এজন্য এখন বিনিয়োগ ও সম্পদ স্থানান্তরের জন্য বাংলাদেশীরা দুবাইকে বেছে নিচ্ছেন। দুবাইয়ে বসবাসকারী বাংলাদেশী একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও অন্য ব্যবসায়ীরা এক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা রাখছেন। বড় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীরাও এখন দুবাইয়ে আউটলেট খুলছেন। ঢাকার বসুন্ধরা সিটিতে দোকান আছে, এমন ব্র্যান্ডগুলোরও দুবাইয়ের বিভিন্ন শপিং মলে শোরুম আছে।’

বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের কাছে দীর্ঘদিন বিদেশে উচ্চশিক্ষার গন্তব্য হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। যদিও এখন অনেকটা আকস্মিকভাবেই এ স্থান দখল করে নিয়েছে আরব আমিরাতের দুবাই-আবুধাবি। জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থার (ইউনেস্কো) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে ১১ হাজার ১৫৭ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন আবুধাবি ও দুবাইসহ ইউএইর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। সে হিসেবে গত বছর বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে বিদেশে যাওয়া মোট শিক্ষার্থীর ২২ শতাংশই গেছেন ইউএইতে। যদিও এর আগে কখনই বিদেশে উচ্চশিক্ষায় বাংলাদেশীদের গন্তব্য হিসেবে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায়ও ছিল না দেশটি। আবার বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত কিউএস র‍্যাংকিংয়েও দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান ১৫০-এরও পরে। আবার সেখানে পড়াশোনার খরচ অনেক বেশি হলেও দুবাই-আবুধাবির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের জন্য তেমন একটা স্কলারশিপও দেয় না।

বিভিন্ন সূত্রের তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এসব শিক্ষার্থী মূলত উচ্চবিত্ত বাংলাদেশীদের সন্তান। দেশের অনেক ধনী ব্যক্তি এখন বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল শহর দুবাইয়ে জমি, বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্টের মতো সম্পত্তি কিনছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সেখানে বাংলাদেশীদের সম্পত্তি কেনার প্রবণতা ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। আবার দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, ব্যাংকারসহ বিত্তবানরা লুফে নিচ্ছেন আরব আমিরাতের গোল্ডেন ভিসা। বাংলাদেশীদের ইউরোপ-আমেরিকায় পাচারকৃত অর্থের একটি অংশও এখন দুবাইয়ে সরিয়ে আনা হচ্ছে। সেখানে ভ্রমণ ভিসায় যাওয়া বাংলাদেশীর সংখ্যাও অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এছাড়া দেশে স্বর্ণ চোরাচালান ও হুন্ডির তৎপরতার কেন্দ্র হিসেবেও আরব আমিরাতের নাম বেশি আলোচিত হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য হলো দুবাইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই জড়িয়ে পড়ছে। তবে সমস্যা হলো আরব আমিরাত থেকে বাংলাদেশে অর্থ আসছে বৈধ পথে, ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে। বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে অর্থ যাচ্ছে অবৈধ পথে—হুন্ডি মারফত। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে দুবাইয়ে অর্থ পাচার আরো বাড়বে।

আরব আমিরাত থেকে যে অর্থ দেশে আসছে সেটি বৈধ আর দেশ থেকে যেটি যাচ্ছে সেটি অবৈধ বলে মনে করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বহু আগে থেকেই আরব আমিরাত বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহের অন্যতম উৎস। অভিবাসী শ্রমিকরা নিজেদের উপার্জিত অর্থ বৈধ চ্যানেলে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছেন। আর বিনিয়োগ ও ঋণ হিসেবে আমিরাত থেকে যে অর্থ আসছে, সেটিও ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে। এসব অর্থের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব আছে। কিন্তু দেশ থেকে যে অর্থ আমিরাত যাচ্ছে, সেটি যাচ্ছে অবৈধ পন্থায়। আমরা দেখছি, দুবাইয়ে বাংলাদেশীদের ব্যবসা-বাণিজ্য, সম্পত্তি থেকে শুরু করে অর্থবিত্ত বাড়ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আরব আমিরাতে উপার্জিত অর্থে যদি কেউ বিনিয়োগ বা সম্পত্তি কেনে, তাহলে আপত্তি নেই। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে অর্থ নিয়ে যদি এসব সম্পদ গড়া হয়, সেটি অবৈধ। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদন নিয়ে কেউ দুবাইয়ে বিনিয়োগ করেছে বলে আমরা শুনিনি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর দায়িত্ব হবে দুবাইয়ে বিনিয়োগ করা বাংলাদেশীদের সম্পদের উৎস খুঁজে বের করা। দুবাই বাংলাদেশীদের অবৈধ অর্থের হাব হয়ে উঠবে, এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।’


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর