মঙ্গলবার, ১৭ই জুন ২০২৫, ২রা আষাঢ় ১৪৩২ | ই-পেপার
ব্রেকিং নিউজ:
  • সারাদেশে জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আগ্রহী হলে আপনার সিভি ই-মেইল করতে পারেন। ই-মেইল daajkaal@gmail.com
সংবাদ শিরোনাম:
  • ভারত-পাকিস্তান আবারও মুখোমুখি হচ্ছে
  • ইসরায়েলি হামলায় ইরানে নিহত বেড়ে ২২৪
  • আজ মেঘলা থাকতে পারে ঢাকার আকাশ
  • নেতানিয়াহুর বাড়ি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাল ইরান
  • সংবাদপত্রের কালো দিবস আজ
  • দুই উপদেষ্টার গাড়ি আটকে বিক্ষোভ, ১৫৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা
  • ফের টিউলিপকে তলব, ৫ ঠিকানায় গেল চিঠি
  • ইসরায়েলের একাধিক স্থানে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা
  • চলন্ত বাসে কলেজছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, চালক আটক
  • কুশাসক-সুশাসক নির্ণয়ের দাঁড়িপাল্লা

কুশাসক-সুশাসক নির্ণয়ের দাঁড়িপাল্লা

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত:
১৬ জুন ২০২৫, ১৫:০৮

মহামতি প্লেটোর একটি অমিয় বাণী দ্বারা আজকের নিবন্ধটি শুরু করতে চাই। প্লেটো বলেছেন, শাসন করার অভিলাষ দ্বারাই কুশাসক-সুশাসক নিরূপণ করা যায়। সুশাসকরা ক্ষমতার জন্য লালায়িত হন না-ক্ষমতা পাওয়ার জন্য অনাসৃষ্টি করেন না এবং ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য অন্যায়, অনিয়ম এবং পাপাচার করেন না। রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ সব সময়ই তাঁদের অভিলাষ বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয়ে থাকে এবং ক্ষমতা পরিচালনার ব্যাপারেও তাঁদের অনাগ্রহ প্রবল থাকে।

কেবল দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ দ্বারা তাড়িত হয়ে তাঁরা ক্ষমতায় থাকেন এবং যে কোনো সময় ক্ষমতা ত্যাগ করার জন্য অসিলা খুঁজতে থাকেন। কিন্তু জনগণের ভালোবাসা, সমর্থন এবং সহযোগিতার কারণে এসব সুশাসক প্রায়ই ক্ষমতা ছাড়ার সুযোগ পান না।

প্লেটোর অমিয় বাণীতে যে অভিলাষের কথা বলা হয়েছে, সেখানে শাসন করার অনাগ্রহ যাঁদের প্রবল থাকে, তাঁরাই কেবল সুশাসক হতে পারেন। কিন্তু যাঁরা সর্বদা শাসক হওয়ার জন্য লালায়িত থাকেন এবং শাসন করার প্রবল ইচ্ছা পোষণ করেন, তাঁরা কোনোকালে সুশাসক হতে পারেন না।

এঁরা প্রায়ই কুশাসক রূপে ইতিহাসে নাম লিখিয়ে জমিনে জীবন্ত গজবরূপে সাধারণ মানুষের ঘৃণা ও বদদোয়ার উপলক্ষ্য হিসেবে বিরাজ করেন। এঁরা কোনোকালে আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকতে পারেন না এবং অত্যন্ত লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে ক্ষমতাহীন অবস্থায় ইহলীলা সাঙ্গ করেন। তাঁদের শাসন করার অভিলাষও কোনোকালে সার্থকতা পায় না। কারণ জনগণ তাঁদের শাসকরূপে মেনে নেয় না।

সুযোগ পেলে অবাধ্য হয়, বিদ্রোহ করে এবং প্রতিশোধ নিয়ে অভিলাষী শাসকদের জনগণ উচিত শিক্ষা দিয়ে থাকে। প্লেটোর উল্লিখিত বাণীটি তামাম দুনিয়ার রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিগত আড়াই হাজার বছর ধরে অন্যতম প্রধান সূত্ররূপে নন্দিত হয়ে আসছে। এই সূত্রের আলোকে পৃথিবীর সর্বকালের কয়েকজন সেরা সুশাসক এবং নিকৃষ্ট কুশাসকের শাসন করার অভিলাষ, শাসক হওয়ার কাহিনি এবং আনুষঙ্গিক ঘটনা বর্ণনা করলেই প্লেটোর চিন্তাধারার বাস্তবতা আপনাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।

ধারাবাহিকতা আলোচনার শুরুতেই উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের কাহিনি বলছি। তিনি মুসলিম জাহানের খলিফারূপে মোট কুড়ি বছর দায়িত্ব পালন করেন।

তাঁকে ঐতিহাসিকরা একবাক্যে উমাইয়া বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলে থাকেন। নরমে-গরমে, কৌশলে এবং বীরত্ব দ্বারা তিনি একটি ধ্বংসপ্রায় সাম্রাজ্যকে এমনভাবে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হন, যার কারণে ইতিহাসে উমাইয়া বংশ প্রায় নব্বই বছরের কৃতিময় গৌরবগাথা রচনা করতে সমর্থ হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী এক হাজার বছর মুসলমানরা এশিয়া-আফ্রিকা এবং ইউরোপের বিস্তীর্ণ এলাকা অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে শাসন করার সুযোগ লাভ করে। এই কারণে খলিফা আবদুল মালিককে ফাদার অব দি কিং বা রাজেন্দ্র বলা হয়ে থাকে।

সুশাসক-বিজেতা-ন্যায়পরায়ণ বিচারক হিসেবে খলিফা আবদুল মালিকের যে সুখ্যাতি রয়েছে তেমনি রাজ্য বিস্তারে, প্রতিপক্ষ দমনে এবং প্রজাদের কল্যাণের জন্য তিনি তাঁর প্রতিপক্ষের ওপর যে নিষ্ঠুরতা চালিয়েছেন, তা আজও মানুষের হৃদয়ে ভয়ংকর এক অনুভূতির জন্ম দেয়। আবদুল মালিকের সফলতা, কৃতিত্ব এবং সুনাম-সুখ্যাতির কথা শুনে ইতিহাসের পাঠক যতটা না আশ্চর্য হন তার চেয়েও বেশি অবাক হন যখন তাঁরা জানতে পারেন যে খলিফা মনোনীত হওয়ার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত তিনি রাজনীতিকে প্রবলভাবে ঘৃণা করতেন এবং রাজসিংহাসন ও ক্ষমতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে সারাক্ষণ ইবাদত ও বন্দেগি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি দিন-রাতের বেশির ভাগ সময় মসজিদে থাকতেন এবং আল্লাহর ইবাদতে এতটা ধ্যানমগ্ন থাকতেন যে দীন-দুনিয়ার কোনো খবর তাঁর জানা ছিল না। তাঁর এই অতিরিক্ত মসজিদপ্রীতির জন্য তৎকালীন জমানার লোকজন তাঁকে মসজিদের ঘুঘু বলে সম্বোধন করতেন।

রাজনীতি ও ক্ষমতার প্রতি আবদুল মালিকের বিতৃষ্ণার কারণ ছিল তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা। তিনি ৬৪৬ খ্রিস্টাব্দে মদিনাতে যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান (রা.)-এর জমানা। তাঁর বয়স যখন ১০ বছর তখন হজরত ওসমান বিদ্রোহীদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। তাঁর পিতা মারওয়ান ইবনে হাকাম ছিলেন হজরত ওসমান (রা.)-এর প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ উজিরে আজম। সব ঐতিহাসিক একবাক্যে সাক্ষ্য দেন যে মারওয়ানের কূটকৌশল, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদির কারণেই হজরত ওসমান (রা.) নির্মম পরিণতির শিকার হন। ফলে তাঁর শাহাদাতবরণের পর সবার ক্রোধ ও ঘৃণা গিয়ে পড়ে মারওয়ানের ওপর। এ অবস্থায় তিনি মদিনা থেকে পালিয়ে দামেস্কে চলে যান, হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর আশ্রয়ে। পরবর্তী সময়ে তিনি অত্যন্ত কৌশলে তাঁর পরিবারের লোকজনকেও দামেস্কে নিয়ে আসেন।

চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর পুরো জমানা ছিল যুদ্ধবিগ্রহ, গুপ্তহত্যা এবং রাজনীতিতে বেইমানি, মোনাফেকি, রক্তপাত, প্রতারণা, জালজালিয়াতির এক নিকৃষ্ট উপাখ্যান। ফলে মারওয়ানপুত্র আবদুল মালিক তাঁর শৈশবকাল থেকে যা দেখেছেন এবং যে নির্মম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন তা তাঁকে রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। বিশেষ করে তাঁর পিতা যখন হজরত আলী (রা.)-এর হাতে বন্দি হলেন এবং ইমাম হাসান (রা.)-এর বদান্যতায় মুক্তি পেলেন এবং পরবর্তী সময়ে ইমাম হাসান (রা.) যখন হজরত মুয়াবিয়া (রা.) এবং মারওয়ানের যৌথ কুটচালে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হলেন এবং বিষপ্রয়োগে নিহত হলেন তখন কিশোর আবদুল মালিকের হৃদয়মন নিদারুণভাবে আহত হলো।

আমির মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ইয়াজিদের ক্ষমতাগ্রহণ, কারবালার যুদ্ধ, ইয়াজিদের নির্মম মৃত্যু এবং মারওয়ানের খলিফা হওয়ার দৃশ্যপট এবং পর্দার অন্তরালে হাজারো রক্তাক্ত ঘটনা আবদুল মালিককে বিষণ্ন করে তুলেছিল। ফলে তিনি দুনিয়ার সবকিছু পরিত্যাগ করে সারাক্ষণ মসজিদে পড়ে থাকতেন। এই অবস্থায় ছেলেকে সিংহাসনমুখী করার জন্য মারওয়ান তাঁর উপদেষ্টারূপে আবদুল মালিককে নিয়োগ দেন এবং পরবর্তী সময়ে মিসরের ডেপুটি গভর্নর ও প্যালেস্টাইনের গভর্নর পদে মনোনয়ন দেন। কিন্তু আবদুল মালিকের অনাগ্রহ এবং উদাসীনতা মারওয়ানকে ব্যথিত করে। এই পর্যায়ে তিনি উত্তরাধিকাররূপে মালিকের পরিবর্তে তাঁর অন্য পুত্র আবদ আল আজিজকে মনোনয়ন দেন। কিন্তু মিসর জয়ের প্রাক্কালে আবদ আল আজিজ নিহত হলে খলিফা মারওয়ান আবদুল মালিককে তাঁর উত্তরাধিকার নিয়োগ দিয়ে দলিল সম্পাদন করেন ৬৮৫ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে।

আবদুল মালিক দীনদুনিয়া ভুলে সারাক্ষণ মসজিদে বসে ইবাদত-বন্দেগিতে এতটা মগ্ন ছিলেন যে খলিফা হিসেবে তাঁর মনোনয়ন সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। অন্যদিকে তাঁর পিতা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে নিহত হওয়ার সময়ও তিনি মসজিদে ছিলেন এবং রাজপ্রাসাদের কর্মকর্তারা যখন মসজিদে এসে আবদুল মালিককে দুটো খবর দিলেন যে খলিফা মারওয়ানকে খুন করা হয়েছে এবং তাঁকে পরবর্তী খলিফারূপে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তখন তিনি পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতরত অবস্থায় ছিলেন। তিনি কোরআন পড়া বন্ধ করে ভাবলেশহীনভাবে রাজপ্রাসাদের কর্মকর্তাদের বক্তব্য শুনলেন এবং মহাবিরক্ত হয়ে আপন মনে বিড় বিড় করতে করতে প্রাসাদ অভিমুখে রওনা দিলেন।

খলিফা আবদুল মালিকের মতো খলিফা দ্বিতীয় ওমর (রা.) অর্থাৎ ওমর ইবনে আবদুল আজিজের ক্ষমতালাভও তাঁর অভিলাষের বিরুদ্ধে হয়েছিল। আব্বাসীয় খলিফা আল মামুনের কাহিনিও প্রায় একই রকম। অন্যদিকে অটোমান সম্রাটদের মধ্যে যিনি কিংবদন্তির বীর, নির্লোভ সম্রাট, সুশাসক ও বিজেতারূপে স্বীকৃত তাঁর নাম সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ, যিনি কোনো দিন সম্রাট হতে চাননি। অধিকন্তু নিজ সন্তান দ্বিতীয় মুহাম্মদের অনুকূলে সিংহাসন ত্যাগ করে অবসরে চলে যান। এই যুগান্তকারী ঘটনার তিন বছর পর রাষ্ট্রের প্রয়োজনে রাজ আমত্যরা আবার তাঁকে জোর করে দ্বিতীয়বারের মতো খলিফারূপে নিযুক্তি দেন। প্রথম দফায় সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ ৪০ বছর রাজত্ব করেন এবং দ্বিতীয় দফায় করেন পাঁচ বছর। মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় মুহাম্মদ পুনরায় খলিফা হন।

সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের মতো তাঁর পুত্র দ্বিতীয় মুহাম্মদও ছিলেন ক্ষমতার প্রতি অনাগ্রহী। কিংবদন্তির সুশাসক ইতিহাসে যাঁকে বিজেতা মুহাম্মদ অর্থাৎ মুহাম্মদ দ্য কনফুয়ারার উপাধিতে ভূষিত করেছে। কারণ তিনিই এক হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল জয় করেছিলেন এবং তাঁর ব্যাপারেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।

ইতিহাসের উল্লিখিত সুশাসকদের বিপরীতে যদি আমরা কুশাসকদের ক্ষমতা লাভের লালসার বিষময় ইতিহাস বলি, তবে একেকজন দুরাচারের লোভ-লালসার ইতিবৃত্ত নিয়ে একেকটি মহাকাব্য রচনা করা সম্ভব। ক্ষমতালাভের পর ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার কাহিনি এবং প্রায় সব ক্ষেত্রে কুশাসকদের নির্মম পরিণতি, অপমানজনক এবং বেদনাদায়ক মৃত্যু এবং তাঁদের বশংবদদের নাজেহাল হওয়ার কাহিনিগুলো নিয়েও একাধিক মহাকাব্য রচিত হতে পারে। কুশাসকরা তাঁদের জন্মের পর থেকেই একটি বিরূপ পরিবেশের শিকার হন এবং সুশাসকদের মতো ইতিবাচক চিন্তা না করে নেতিবাচক চিন্তা এবং প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে বেড়ে ওঠেন।

চেঙ্গিস-হালাকু-হিটলার মুসোলিনিসহ অন্যান্য নিকৃষ্ট শাসকের জন্ম-শৈশব-কৈশোর এবং সক্ষমতা লাভের পূর্বাপর ঘটনা বিশ্লেষণ করলে আপনি যে সমীকরণ পাবেন ঠিক একই সমীকরণ পাবেন ইরান-তুরান-উগান্ডা-বুগান্ডার কুশাসকদের চরিত্রে। এখন প্রশ্ন হলো, সুশাসকরা কেন ক্ষমতার প্রতি নিরাসক্ত থাকেন এবং শাসন করার ব্যাপারে অনাগ্রহী মনোভাব পোষণ করেন। অন্যদিকে কুশাসকরা কেন নিজেরা রক্তের বন্যার মধ্যে প্রতঙ্গরূপে ভাসতে ভাসতে কোনোমতে প্রাণ বেঁচে যাওয়ার পর রক্তকে ভয় না পেয়ে উল্টো রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়ার জন্য অথবা রক্ত দিয়ে হোলি খেলার জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠেন? বিষয়টি জটিল এবং গবেষণার বিষয়। সুতরাং অনাগত দিনে সময়-সুযোগ হলে এ ব্যাপারে বিস্তারিত লেখার আশা পোষণ করছি।

 

 


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর