প্রকাশিত:
১১ জুন ২০২৫, ১৭:০৭
দেশের চামড়া ও চামড়াজাত শিল্প বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাচ্ছে। বিশেষ করে দেশে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বৈশ্বিক মান সনদের অভাবে এর কদর দিন দিন কমছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, ঈদুল আজহার সময় হঠাৎ প্রচুর চামড়া বাজারে আসে, কিন্তু তা যথাযথভাবে সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করার মতো অবকাঠামো না থাকায় চাহিদা কমছে। ফলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা হারাচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিক্রয়ের জন্য সুসংগঠিত একটি বাজার নেই। ঈদুল আজহার সময় হঠাৎ প্রচুর চামড়া বাজারে আসে, কিন্তু তা যথাযথভাবে সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করার মতো অবকাঠামো না থাকায় চাহিদা কমছে। এ ছাড়া সাভারের ট্যানারিপল্লী পরিপূর্ণভাবে কার্যকর না হওয়ায় প্রক্রিয়াকরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক ট্যানারি এখনো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে রূপান্তর করতে পারেনি।
ফলে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা আগ্রহ হারাচ্ছে। ভারত, চীন, ভিয়েতনাম এসব দেশ কম খরচে চামড়া সরবরাহ করছে। ফলে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। এদিকে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও এবারও কোরবানির চামড়া বাজারে ধস দেখা দিয়েছে।
আড়তগুলোয় চামড়া বিক্রি করতে এসে এবারও ন্যায্য মূল্য পাননি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া সরকারের নজরদারির পরও যথাযথ সংরক্ষণ, পরিবহন এবং তীব্র গরমে এবারও ১৫-২০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে এক কোটি পিস চামড়া সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ৭০-৮০ লাখ পিস সংগ্রহ হবে বলে জানিয়েছেন বিটিএ।
সরেজমিনে রাজধানীর পোস্তা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া বিক্রি করতে পারেননি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। গরুর চামড়া মানভেদে ৭০০-৮০০ টাকায় বিক্রি করা হলেও ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে প্রতি পিস ৫-১০ টাকায়।
অবশ্য বাণিজ্য ও শিল্প উপদেষ্টারা জানিয়েছেন, গত ১০ বছরের মধ্যে কাঁচা চামড়ার সর্বোচ্চ দাম পেয়েছেন এবারের ব্যবসায়ীরা। তবে চামড়ায় দেরিতে লবণ দেওয়ার কারণে এবার কোরবানির পশুর চামড়ায় কাঙ্ক্ষিত দাম অনেকেই পাননি বলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা ত্রিশ হাজার মেট্রিক টন লবণ দিয়েছি। তবু কিছু জায়গায় চামড়ায় লবণ ঠিকমতো না লাগানোর কারণে চামড়া নষ্ট হয়েছে।’
যথাযথা সংরক্ষণ, নির্ধারিত সময়ের বেশ পরে বাজারে নিয়ে আসায় ১৫-২০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছেন কাঁচা চামড়া আড়তদাররা। আর মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ন্যায্য দাম পাননি।
বাংলাদেশ কাঁচা চামড়ার আড়তদার সমিতির মহাসচিব টিপু সুলতান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার বেঁধে দেওয়া দাম যৌক্তিক হয়নি বলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ন্যায্য দাম পাননি। সরকারের অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা না করে যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে সেটি বর্তমান বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য ছিল না। এ ছাড়া বাজারে অর্থের জোগানও কম ছিল। এ বছরও আড়তদারদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া যায়নি। এখনো ট্যানারির কাছে আড়তদারদের বকেয়া ১১০ কোটি টাকা।’
তিনি আরো জানান, সরকার ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে সমন্বয় করতে সফল হয়নি। এ ছাড়া ট্যানারি মালিকদের কাছে ১৭ বছরের বকেয়া টাকা প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা পান, যা না পাওয়ায় তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি।
অন্যদিকে মাদরাসা ও এতিমখানায় দেওয়া লবণের ভর্তুকি কাজে আসেনি। এর পরিবর্তে যদি লবণের বাজারমূল্য কমানো হতো, তাহলে প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা কিছুটা হলেও লাভবান হতেন।
গত সোমবার পোস্তা বাজারে ১০০ চামড়া নিয়ে আসেন ফতুল্লার মানিক সরকার। কালের কণ্ঠকে তিনি জানান, ৭০০-৮০০ টাকা দরে চামড়া কিনেছেন। লবণ ও পরিবহন খরচসহ একেকটি চামড়ার খরচ পড়েছে ৯০০ টাকা। অথচ বাজারে কেউ ৮০০ টাকার বেশি দিচ্ছে না।
এই প্রসঙ্গে টিপু সুলতান বলেন, সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম যৌক্তিক ছিল না। ফলে এবার বাজারে কাঁচা চামড়ার গড় দাম ছিল ৭৫০-৮০০ টাকা। এ ছাড়া প্রচণ্ড গরম এবং যথাযথ সংরক্ষণ করতে না পারায় অনেক চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে।
বিটিএ সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত ঊল্ল্যাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবারের কোরবানির চামড়া সংগ্রহ ব্যবস্থাপনা অন্যবারের চেয়ে তুলনামূলক ভালো ছিল। বিশেষ করে সরকারের উদ্যোগে স্থানীয় পর্যায়ে মাদরাসা ও এতিমখানাগুলো ভালো পরিমাণ চামড়ায় লবন দিয়ে সংগ্রহ করেছে। ফলে গত বছরের চেয়ে এ বছর সাভারের ট্যানারিপল্লীতে চামড়া সংগ্রহ কম হয়েছে।’ এ ছাড়া ১৫-২০ শতাংশ কোরবানি কম হয়েছে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, ‘গত বছর সংগ্রহ করা হয়েছিল ছয় লাখ পিস। এবার সংগ্রহ হয়েছে দুই লাখ ৭৮ হাজার পিস। চামড়া নষ্টের খবর তেমন পাওয়া যায়নি। চট্টগ্রামে ২৬০ পিস চামড়া, যেগুলো ছিল লবণ ছাড়া এবং অনেক দেরিতে বাজারে নিয়ে আসা হয়েছিল। এ বছর ৭০-৮০ লাখ চামড়া সংগ্রহ হবে।
দাম নেই ছাগলের চামড়ার, বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকা দরে
বিশ্বে ছাগলের চামড়ার যথেষ্ট চাহিদা থাকলেও দেশে এর দাম নেই বললেই চলে। এবার ছাগলের চামড়ার দাম নেমে এসেছে মাত্র পাঁচ টাকায়। দাম না পেয়ে কেউ কেউ চামড়া পুঁতে ফেলেছেন, কেউ ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে ছাগলের চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা কম। পাশাপাশি ট্যানারির সংখ্যা কমে যাওয়ায় এ চামড়ার চাহিদা কমেছে।
একজন মৌসুমি ব্যবসায়ী বলেন, ‘ঘুরে ঘুরে গাড়িভাড়া দিয়ে আমরা যে মাল কিনেছি, কিন্তু আড়তে এসে আমরা সেভাবে বিক্রি করতে পারছি না। লস মেনে নিয়েই চামড়া দিয়ে দিতে হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত।’
মন্তব্য করুন: