সোমবার, ৯ই জুন ২০২৫, ২৬শে জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | ই-পেপার
ব্রেকিং নিউজ:
  • সারাদেশে জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আগ্রহী হলে আপনার সিভি ই-মেইল করতে পারেন। ই-মেইল daajkaal@gmail.com
সংবাদ শিরোনাম:
  • ওয়ারেন্ট না থাকায় আবদুল হামিদকে গ্রেপ্তার করা হয়নি
  • গত অর্থবছরকে ছাড়িয়ে গেছে ১১ মাসের রপ্তানি আয়
  • ভোটারদের নিয়ে নিজেই শপথ পড়ে চেয়ারে বসে পড়ব
  • টাঙ্গাইলে মহাসড়কে ডাকাতি
  • রাজশাহীতে ৫৭ কেজি গাঁজাসহ মাদক কারবারি গ্রেফতার
  • মানুষকে দু-মুঠো খাওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়ার দল বিএনপি
  • করাচিতে জেল ভেঙ্গে পালিয়েছে দুই শতাধিক কয়েদি
  • আগামী বিশ্বকাপের জন্য ভারতের চার ভেন্যু চূড়ান্ত, পাকিস্তান খেলবে কোথায়?
  • সমান্তরাল বিষাদ
  • চাকরিপ্রার্থীদের জন্য গুগলের নতুন এআই টুল ‘ক্যারিয়ার ড্রিমার

বুড়িগঙ্গার জায়গায় সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালীদের ডকইয়ার্ড

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত:
২৯ জুন ২০২৪, ১৩:৩০

ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের পার গেন্ডারিয়ার আপিস মাঠ এলাকায় একটি খাল বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গে মিশেছে। স্থানীয়ভাবে এটি শুভাঢ্যা খাল নামে পরিচিত। এই খাল ও নদীর মধ্যবর্তী তীরের চর কালীগঞ্জের তেলঘাট পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে ২৭টি ডকইয়ার্ড বা নৌযান তৈরি ও মেরামত কারখানা।

এসব ডকইয়ার্ড অবৈধভাবে নদীসীমার মধ্যে গড়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। ডকইয়ার্ডের মালিকদের মধ্যে রয়েছেন সংসদ সদস্য, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগের নেতাও।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কর্মকর্তারা বলছেন, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ডকইয়ার্ডের মালিক হওয়ার কারণে এগুলো উচ্ছেদ করা যায় না। তাঁরা নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে অবৈধভাবে ডকইয়ার্ডগুলো টিকিয়ে রেখেছেন।

গত মাসে সরেজমিনে দেখা গেছে, আপিস মাঠ এলাকার বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে আলু সংরক্ষণাগার (কোল্ড স্টোরেজ) রয়েছে। ওই সংরক্ষণাগার থেকে চর খেজুরবাগ হয়ে তেলঘাট পর্যন্ত শুভাঢ্যা খাল ও নদীর জায়গায় এসব ডকইয়ার্ড গড়ে তোলা হয়েছে। নদীসীমার মধ্যে এতগুলো ডকইয়ার্ড গড়ে ওঠার কারণে আপিস মাঠ এলাকা থেকে তেলঘাট পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার প্রশস্ততা কমে গেছে। পোড়া তেলে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে।

■ নদীর সীমানা চিহ্নিত করে বসানো হয়েছে খুঁটি।

■ খুঁটিতে স্পষ্ট যে ডকইয়ার্ডের স্থাপনা নদীর জমির ভেতরে পড়েছে।

■ জমি দখলের কারণে সরু হয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা।

সরেজমিনে জানা যায়, দুটি ডকইয়ার্ডের মালিক বরিশাল-৩ আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া (টিপু)। দুটির মালিক শুভাঢ্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হোসেন। একটি ডকইয়ার্ড দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রভাবশালী একজন সংসদ সদস্যের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানা গেছে। বাকিগুলোর মালিকেরা সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত নন। তবে তাঁরাও প্রভাবশালী।

ডকইয়ার্ড ও লঞ্চ ব্যবসায় প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া গত ২৩ মে ঢাকার নয়াপল্টনে নিজের কার্যালয়ে দাবি করেন, তাঁর ডকইয়ার্ড দুটি ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে গড়ে উঠেছে। ওই জমি বন্ধক রেখে একজন ঋণ নিয়েছিলেন। তিনি জমির মালিকের হয়ে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করে জমি ক্রয় করেন। অন্য ডকইয়ার্ডগুলোও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে গড়ে উঠেছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনা আছে। এ কারণে বিভিন্ন সময়ে এগুলো উচ্ছেদ করতে এসেও নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে ফিরে যেতে হয়েছে।

তবে বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এ কে এম আরিফ উদ্দিন বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, শুভাঢ্যার ডকইয়ার্ডগুলো অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে। এগুলোর মালিকানাসংক্রান্ত বিষয়ে উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনা ছিল। পরে সেটি বাতিল করা হয়েছে। বাস্তবে ডকইয়ার্ডগুলো নদীর সীমানা পিলারের (খুঁটি) ভেতরে নদীর অংশে পড়েছে।

যে কারণে উচ্ছেদ করা যায় না

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে এক বৈঠকে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী কেরানীগঞ্জ থেকে সব ডকইয়ার্ড সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগের জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তবে সাড়ে তিন বছর পরও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন—এই প্রশ্নে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, ডকইয়ার্ডের মালিকেরা বলে থাকেন, কেরানীগঞ্জের এই এলাকা নৌযান তৈরির অন্যতম কেন্দ্র। ডকইয়ার্ডগুলো উচ্ছেদ করলে নৌযানের নির্মাণ ও মেরামতের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে। তাই এগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত উচ্ছেদ করা হচ্ছে না।

জানা গেছে, ডকইয়ার্ডগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য সরকার একটি প্রকল্প নিচ্ছে। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত হলো ডকইয়ার্ডগুলো অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে। পুনর্বাসন করে তাঁদের এখান থেকে উঠিয়ে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, এখানে পিলার দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে ২০১২-১৪ সালের দিকে। কিন্তু এই স্থাপনাগুলো ছিল অনেক আগে থেকে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, দেড় কিলোমিটার নদীসীমার মধ্যে গড়ে ওঠা ২৭টি ডকইয়ার্ড উচ্ছেদ করা না গেলেও চর মীরেরবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি ভবন ঠিকই ভেঙে দিয়েছেন নৌপরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। চর মীরেরবাগ অংশের ৯ ও ১০ নম্বর পিলার ঘেঁষে নদীর জমিতে গড়ে উঠেছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি ভবন। ২০১৯ সালে ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়।

তবে ওই বিদ্যালয় থেকে পূর্ব দিকে এগোলে ১১ ও ১২ নম্বর পিলারের মাঝামাঝি কুমিল্লা ডকইয়ার্ড গড়ে উঠেছে। সীমানা পিলারের ভেতরের অংশ লোহার পাত দিয়ে দখল করা হয়েছে। স্কুলের পশ্চিম পাশেও একটি ডকইয়ার্ড রয়েছে। এই অংশে স্থানীয় শুভাঢ্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন, তাঁর ভাই সোহেল রেজা ও বাছের উদ্দিনের আলাদা ডকইয়ার্ড রয়েছে।

ইকবাল হোসেন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক, তাঁর এক ভাই সোহেল রেজা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং আরেক ভাই বাছের উদ্দিন শুভাঢ্যা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। শুভাঢ্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন কেরানীগঞ্জ ডকইয়ার্ড মালিক সমিতির সভাপতির দায়িত্বেও রয়েছেন।

এসব বিষয়ে শুভাঢ্যা ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেনের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে বিষয়বস্তু লিখে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি। তবে ইকবাল হোসেনের ভাই সোহেল রেজা বলেন, তাঁদের ডকইয়ার্ডটি পৈতৃক সম্পত্তিতে গড়ে উঠেছে। আগে এসব ডকইয়ার্ডের জন্য বিআইডব্লিউটিএকে ফি দেওয়া হতো। এখন বিআইডব্লিউটিএ সেটা নিচ্ছে না।

‘বৈধ হতে পারে না’

সরেজমিনে ঘুরে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডকইয়ার্ডের মালিকেরা প্রভাবশালী হওয়ার কারণে এগুলো উচ্ছেদ বা সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া যায়নি। তাঁরা নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে অবৈধভাবে ডকইয়ার্ডগুলো টিকিয়ে রেখেছেন। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কঠোর সিদ্ধান্ত না এলে অবৈধ ডকইয়ার্ড উচ্ছেদ করা অসম্ভব।

এই বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, নদীর সীমানা চিহ্নিত করতে উচ্চ আদালতের যে নির্দেশনা রয়েছে, সেটির উদ্দেশ্যই ছিল অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা। এখন সীমানা পিলারের ভেতরে কোনো স্থাপনা থাকলে সেটি কোনোভাবেই বৈধ হতে পারে না। তিনি বলেন, শুভাঢ্যায় খাল ও নদীর জমি দখল করে স্থাপনা ও ডকইয়ার্ড নির্মাণে জড়িত ব্যক্তিরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তাঁদের উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। নদী রক্ষার জন্য এসব স্থাপনা উচ্ছেদের কোনো বিকল্প নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এগুলো দ্রুততম সময়ে দখলমুক্ত করা।


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর