বৃহঃস্পতিবার, ৫ই ডিসেম্বর ২০২৪, ২০শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | ই-পেপার
ব্রেকিং নিউজ:
  • সারাদেশে জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আগ্রহী হলে আপনার সিভি ই-মেইল করতে পারেন। ই-মেইল daajkaal@gmail.com
সংবাদ শিরোনাম:
  • পলাতক ৭০০ বন্দি এখনও অধরা
  • ইসি সচিবালয়ের সচিব শফিউল আজিমকে ওএসডি
  • পিলখানা হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ উদ্‌ঘাটনে স্বাধীন কমিশন গঠন
  • আবারও পুলিশে বড় রদবদল
  • সচিবালয়ে কর্মচারীদের মহাসমাবেশ স্থগিত
  • কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল শুরু
  • ঢাকার বাতাস আজ ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’
  • দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াবে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া
  • আদালতে আত্মসমর্পণ করলেন সেই তাপসী তাবাসসুম
  • আইনজীবী আলিফের জানাজায় হাসনাত-সারজিস

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: রোল মডেল বনাম মাঠ-বাস্তবতা

ডেস্ক রির্পোট

প্রকাশিত:
২৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৫:২১

গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কে একধরনের স্থিতাবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় থেকেই রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের ভালো বোঝাপড়া ছিল। বিশেষ করে কংগ্রেস দলের উচ্চ নেতৃত্বের সঙ্গে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঘনিষ্ঠতা ছিল বরাবর। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর এবং প্রণব মুখার্জির সঙ্গে শেখ হাসিনার সুসম্পর্ক সুবিদিত।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, ভারতে তখন কংগ্রেস ক্ষমতাসীন। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে পরাজিত হয়ে কংগ্রেস ক্ষমতা হারায়। বিজয়ী হয় বিজেপি, নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।

কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের সৌহার্দ্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে অনেকে ভেবেছিলেন, এবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারত সরকারের বিশেষ সম্পর্কের অবসান হবে। বস্তুত এ রকম ধারণা অনেকটাই ছিল অজ্ঞতাপ্রসূত। ভারতের জন্য আওয়ামী লীগ হচ্ছে একটি পরিচিত সংগঠন এবং ভারতের যেকোনো সরকারের জন্যই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার থাকা সুবিধাজনক।

ভারত কেন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বদলে স্থিতিশীলতার কথা বলছে
রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপের ভিন্ন পাঠ
নির্বাচন, জাতিসংঘ ও বিদেশি হস্তক্ষেপ–বিতর্ক

প্রথমে কংগ্রেস এবং পরে বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারতের সঙ্গে গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। দুই পক্ষেরই নেতাদের মুখ থেকে সম্পর্কের সোনালি সময় চলছে, সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে ইত্যাকার বাক্যাবলি নিঃসৃত হয়েছে নিয়মিত বিরতিতে। এর সঙ্গে আর যে বাক্যটি যোগ হয়েছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ‘রোল মডেল’।

১৮ ডিসেম্বর দৈনিক ভোরের কাগজ ‘জহুর হোসেন চৌধুরী মেমোরিয়াল লেকচার ২০২৩’–এর আয়োজন করে স্থানীয় একটি হোটেলে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশ-ভারত প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কের রোল মডেল’। সম্পাদক শ্যামল দত্তের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের মূল বক্তা ছিলেন দুজন—বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার (পরে ভারতের ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজর) পঙ্কজ সরণ ও ভারতে বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার তারেক করিম।

পঙ্কজ শরণ তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, বাংলাদেশে কীভাবে নির্বাচন হবে, সেটা দেশের জনগণ ও গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলোই ঠিক করবে। এ নিয়ে মূল্যায়নের অধিকার অন্য কাউকে দেওয়া হয়নি। ‘স্থিতিশীলতা’ বজায় রাখার ওপরও তিনি গুরুত্ব দেন।


অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপ যে খুব সম্মানজনক, তা অবশ্যই নয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সুযোগ থাকলে শক্তিমানেরা তুলনামূলক দুর্বলদের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। তা যেমন করে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ, তেমনি করে ভারত বা চীন।

৭ জানুয়ারির নির্বাচনে মার্কিনদের কথিত হস্তক্ষেপ নিয়ে সোচ্চার ভারত, চীন ও রাশিয়া। ভারত নিজেই কিন্তু হস্তক্ষেপ করেছিল ২০১৪ সালের নির্বাচনে।

এসব হস্তক্ষেপ নীতির আলোকে হয় না, হয় স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র চাইছে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, যা বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণেরও চাওয়া। পক্ষান্তরে ২০১৪ সালে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংয়ের হস্তক্ষেপ ছিল একটি সাজানো নির্বাচনের পক্ষে। বিস্তারিত জানতে চাইলে প্রথমা থেকে প্রকাশিত অধ্যাপক আলী রীয়াজের নিখোঁজ গণতন্ত্র বইয়ের দ্বাদশ অধ্যায়টি পড়ে দেখতে পারেন।

ফিরে আসি রোল মডেল প্রসঙ্গে। শব্দবন্ধটির প্রকৃত অর্থ কী? আপাতদৃষ্টে তো মনে হয়, এর অর্থ হচ্ছে বর্ণিত দুটি দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে যা কিছু ঘটে, এর বাইরে কোনো দুটি দেশের জন্য তা আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং সেই দেশগুলো এরূপ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করবে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বাস্তবেই কি এমন নজির স্থাপন করছে?

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দিল্লিতে আলোচনা কেন
দেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ কি নতুন কিছু, সামনে কী
ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে অবশ্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে একটা আদর্শ পরিবেশ বিরাজ করছে। ভারতের যা কিছু চাওয়ার ছিল, বাংলাদেশ তার প্রায় সবকিছুই পূরণ করেছে প্রায় কোনো বিনিময় ছাড়াই। উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং তাদের কোনো কোনো নেতাকে ভারতের কাছে সমর্পণ করা হয়।

বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর ট্রানজিট–সুবিধা দেওয়া হয়েছে ভারতকে। বাংলাদেশের বাজারে ভারতীয় পণ্যের প্রবেশ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। বিপুলসংখ্যক ভারতীয় বাংলাদেশের কর্মবাজারে প্রবেশ করেছেন এবং বছরে তাঁদের রেমিট্যান্স পাঁচ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

পর্যটন এবং চিকিৎসাসফরে যাওয়া বাংলাদেশিদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।

বাংলাদেশের উপকূলে ভারতীয় নজরদারি রাডার স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ এবং ভারত থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কিছু অস্ত্রও কিনেছে। ছোট ছোট আরও কিছু প্রাপ্তির কথা নাহয় বাদই দিলাম।

পক্ষান্তরে বাংলাদেশের প্রাপ্তির তালিকাটা বেশ কষ্টকল্পিত। সীমান্ত নিয়ে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুসমর্থন করতে ভারত সময় নিয়েছে ৪০ বছর, তা-ও ভারতের পক্ষে যায়, তেমন খানিকটা পরিবর্তন এনে। বাংলাদেশ থেকে নেপাল, ভুটানের সঙ্গে স্থলপথে যে সামান্য দূরত্ব, ভারতের ভেতর দিয়ে তা পেরোনোর জন্য ট্রানজিট–সুবিধা পাওয়া যায়নি এখনো।

তিন-চার দফায় সাত বিলিয়ন ডলার ক্রেডিট লাইন দিয়েছে ভারত। কিন্তু কঠিন শর্তের কারণে অর্থছাড়ের পরিমাণ কম। গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। তিস্তার পানিবণ্টনের চুক্তি হয় হয় করতে করতে একপর্যায়ে হিমাগারে চলে গেছে এবং শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় পানি পায় না। ৫৪ আন্তর্জাতিক নদীর বাকিগুলো নিয়ে কোনো কথাই নেই।

ভারতের আসাম রাজ্যের ‘বিদেশিদের’ বিতাড়নের লক্ষ্যে প্রণীত আসাম নাগরিক পঞ্জি এবং ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধন আইন ডেমোক্লিসের তরবারির মতো ঝুলে আছে বাংলাদেশের ওপর। সেই সঙ্গে আছে লাগামহীনভাবে বিজেপি উচ্চ নেতৃত্বের বাংলাদেশের প্রতি অবমাননাকর বাক্যবাণ।


সবকিছু ছাড়িয়ে যে বিষয়টি বাংলাদেশের জনমনে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি করে, তা হচ্ছে সীমান্তে অব্যাহতভাবে ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা। সম্পর্কের সোনালি অধ্যায় সত্ত্বেও ২০০৯ সালে ৬৭ জন বাংলাদেশি নাগরিক বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছেন। ২০১০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৬০, ২০১১-তে ৩৯, ২০১২-তে ৩৪, ২০১৩-তে ২৮, ২০১৪-তে ৪০, ২০১৫-তে ৪৫, ২০১৬-তে ২১, ২০১৭-তে ২৫, ২০১৮-তে ১১, ২০১৯ সালে ৪১, ২০২০-এ ৫১, ২০২১-এ ১৭ এবং ২০২২ সালে ১৮ জন।

ভারতীয় নেতৃত্বের পক্ষ থেকে এ সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি বারবার উচ্চারিত হয়েছে, কিন্তু তা বাস্তবে রূপ লাভ করেনি; বরং ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর প্রকারান্তরে বলেই দিয়েছেন যে এ হত্যাকাণ্ড চলমান থাকবে। কারণ, সীমান্তে অপরাধ বন্ধ না হলে হত্যাও বন্ধ হবে না।

সীমান্ত হত্যা প্রধানত সংঘটিত হয় গরু পাচারকারীদের ওপর। ভারত থেকে ফেনসিডিল মাদক যাঁরা পাচার করেন বাংলাদেশে, তাঁদের কেউ কখনো হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, এমনটি কিন্তু শুনিনি।

‘রোল মডেল’-এর তাহলে কী হবে? রোল মডেল মানে তো এমন কিছু, যা অনুসরণীয় বা অনুসরণযোগ্য।

সম্প্রতি ইউরোপের বলকান অঞ্চলে এক সফরে আমি বেশ কিছু সীমান্ত অতিক্রম করেছি স্থলপথে। বুলগেরিয়া থেকে রুমানিয়া, রুমানিয়া থেকে সার্বিয়া, সার্বিয়া থেকে বসনিয়া, এরপর মন্টেনেগ্রো, আলবেনিয়া, কসোভো।

বলকানে ভয়ংকর সংঘাতের স্মৃতি এখনো জনমনে জাগরূক। কিছু চোরাচালান যে হয় না তা-ও কিন্তু নয়, তবে মানুষ মেরে তা থামানোর কোনো চেষ্টা নেই। এরপরও এ দেশগুলো বলছে না তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ‘রোল মডেল’। বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে মাঠের বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে।


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর