বৃহঃস্পতিবার, ৫ই ডিসেম্বর ২০২৪, ২০শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | ই-পেপার
ব্রেকিং নিউজ:
  • সারাদেশে জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আগ্রহী হলে আপনার সিভি ই-মেইল করতে পারেন। ই-মেইল daajkaal@gmail.com
সংবাদ শিরোনাম:
  • পলাতক ৭০০ বন্দি এখনও অধরা
  • ইসি সচিবালয়ের সচিব শফিউল আজিমকে ওএসডি
  • পিলখানা হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ উদ্‌ঘাটনে স্বাধীন কমিশন গঠন
  • আবারও পুলিশে বড় রদবদল
  • সচিবালয়ে কর্মচারীদের মহাসমাবেশ স্থগিত
  • কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল শুরু
  • ঢাকার বাতাস আজ ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’
  • দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াবে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া
  • আদালতে আত্মসমর্পণ করলেন সেই তাপসী তাবাসসুম
  • আইনজীবী আলিফের জানাজায় হাসনাত-সারজিস

নতুন তেলক্ষেত্রের পরিণতিও কি হরিপুরের মতো হবে

ডেস্ক রির্পোট

প্রকাশিত:
২০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৬:১০

বাংলাদেশে কোনো কোনো সময় খনিজ তেলের আবিষ্কার ঘটে এবং তা সংবাদমাধ্যম ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ ইতিবাচক আশাবাদ সৃষ্টি করে।

প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা আশাব্যঞ্জক বক্তব্য দিয়ে নিজেদের স্বস্তিকর অনুভূতি প্রকাশ করেন এবং কৃতিত্বের ভাগীদার হওয়ার প্রয়াস পান।

বড় কর্তাদের কেউবা কূপ খনন স্থানে গিয়ে খনিবিদদের পিঠ চাপড়ে বাহবা দিয়ে আসেন। কিন্তু এরপর বিষয়টি নিয়ে কার্যকর উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়ার কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।

কিছুদিনের মধ্যে তেল আবিষ্কার নিয়ে আর কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করেন না। যে ভূতত্ত্ববিদ ও কারিগরি ব্যক্তিরা এ ধরনের আবিষ্কারের সঙ্গে কার্যকরভাবে জড়িত থাকেন, তাঁদের সমন্বয়ে কোনো কারিগরি দল গঠন করে তেলক্ষেত্রটির সার্বিক উন্নয়নের যথার্থ কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।

আবিষ্কার করা একটি কূপ থেকে প্রাকৃতিকভাবে যে কয় বছর আপনা–আপনি তেল বের হতে থাকে, তাতেই তেল কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকে। ওই একটি কূপ থেকে মোট তেল মজুতের অল্প অংশ এভাবে উৎপাদিত হওয়ার পর কয়েক বছরের মধ্যে তা বন্ধ হয়ে যায়। মাটির নিচে পড়ে থাকে তেলের মজুতের বড় অংশ। এটি একটি অপরিপক্ব দুর্বল ব্যবস্থাপনার সাক্ষ্য বহন করে।

তেলক্ষেত্র উন্নয়নের জন্য যে বৈজ্ঞানিক প্রথা প্রচলিত রয়েছে, সে অনুসারে ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে তেলক্ষেত্রটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এটি ঘটেছে ইতিপূর্বে আবিষ্কৃত বাংলাদেশের প্রথম তেলক্ষেত্র হরিপুরে। প্রশ্ন হলো, এবারও কি নতুন এই তেলক্ষেত্রে তা-ই ঘটবে?



১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে প্রথম তেলের খনি হরিপুর আবিষ্কৃত হয়। দেশব্যাপী যথেষ্ট আশাবাদের মধ্য দিয়ে তার উৎপাদন শুরু হয় ১৯৮৭ সালে। সিলেট-৭ নামে আবিষ্কৃত কূপটি দিয়েই তেল উৎপাদন শুরু হয়।

তেলক্ষেত্রের নিজস্ব প্রাকৃতিক শক্তির মাধ্যমেই কূপটি দিয়ে তেল ওপরে আসতে থাকে। তেলকূপটি থেকে প্রথম পর্যায়ে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ ব্যারেল তেল উঠে এলেও ধীরে ধীরে তেলের চাপ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তেল উঠে আসার মাত্রাও কমে যায়।

এ অবস্থায় তেল স্তরের চাপ বৃদ্ধির লক্ষ্যে তেলক্ষেত্র উন্নয়নের স্বতঃসিদ্ধ প্রথা অনুযায়ী কূপটিতে কোনো যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা (যেমন পাম্প স্থাপন করা) প্রয়োগ করা হয়নি বা তেলক্ষেত্র উন্নয়নের লক্ষ্যে নতুন কূপও উৎপাদনের আওতায় আনা হয়নি। ফলে সাত বছর পর্যন্ত কূপটি তার নিজস্ব শক্তি দিয়ে অল্প হারে তেল উৎপাদন করার পর বন্ধ হয়ে যায়।

এ যেন নতুন জন্ম নেওয়া হরিপুর তেলকূপটি তার শৈশব পার হওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পাওয়ার কারণে অপমৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছায়। পরে হরিপুর তেলক্ষেত্রটি নিয়ে আর কোনো উৎপাদন পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি।

প্রাথমিক জরিপের হিসাব অনুযায়ী, হরিপুর তেলক্ষেত্রে অন্তত ১ কোটি (বা ১০ মিলিয়ন) ব্যারেল তেল মজুত রয়েছে। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত এই সাত বছরে তেলক্ষেত্রটি থেকে মোট প্রায় ৫ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদিত হয়। অর্থাৎ তেলক্ষেত্রে যে মজুত, তার মাত্র ৫ শতাংশ তেল উত্তোলন করা হয়। মাটির নিচে রয়ে যায় বাকি প্রায় ৯৫ শতাংশ তেল।



পুরো আমদানিনির্ভর হওয়ার ঝুঁকিতে জ্বালানি খাত
তেলক্ষেত্র উন্নয়নের প্রচলিত প্রথা কী রকম
যে কূপে তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়, তা থেকে সচরাচর আপনা–আপনি তেল বের হয়ে থাকে। কারণ, মাটির নিচে অবস্থানকালে তেল চাপে থাকে এবং এই চাপই তাকে ওপরে উঠিয়ে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তার চাপ কমে যাওয়ার ফলে তেল উৎপাদন কমে যেতে থাকে ও কিছুদিনের মধ্যে তা থেকে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।

আর এ সময় তেল উৎপাদনে সহায়তা করার জন্য আর্টিফিশিয়াল লিফটিং অর্থাৎ কূপের ভেতর কৃত্রিম উত্তোলন যন্ত্র (যেমন পাম্প) লাগানোর সাহায্যে তেল উত্তোলন করা একটি প্রচলিত প্রথা। এ ক্ষেত্রে রড পাম্প স্থাপনের প্রচলন অতি স্বাভাবিক, যা কিনা কারিগরিভাবে স্বল্প খরচ ও সহজ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই করা হয়ে থাকে।

রড পাম্প ব্যবহারের ফলে তেল তার শক্তি ফিরে পায় ও পুনরায় বেশি হারে তেল উৎপাদন করতে পারে। তেলক্ষেত্রের ভেতরে এ রকম একাধিক কূপ খনন ও উৎপাদন করা হয়ে থাকে। পরে কোনো একসময়ে চাপ কমে যাওয়ার কারণে পাম্পের সাহায্যেও আর তেল ওঠানো যায় না। তেল উৎপাদনের এই পর্যায়কে প্রাইমারি রিকভারি বা প্রাথমিক উত্তোলন পর্যায় বলা হয়ে থাকে।

তেল উৎপাদনের প্রাথমিক পর্বটি শেষ হলে এরপর সেকেন্ডারি রিকভারি বা মাধ্যমিক পর্যায়ে উৎপাদন করা হয়। সেকেন্ডারি রিকভারি করার জন্য তেলক্ষেত্রের বাইরে পার্শ্ববর্তী স্থানে নতুন কূপ খনন করে তার ভেতর দিয়ে মাটির নিচে পানি ঢোকানো হয়। এসব কূপকে ইনজেকশন কূপ বলা হয়ে থাকে। এই কূপগুলোর মাধ্যমে পানি প্রবেশ করালে সেই পানি তেলস্তরের দিকে গিয়ে তেলস্তরের চাপ বৃদ্ধি করে, ফলে আবার তেল উৎপাদন শুরু হয়। এই পদ্ধতিতে তেল উৎপাদন দীর্ঘ সময় ধরে চালিয়ে যাওয়ার প্রচলন বিশ্বের সব তেল উৎপাদক দেশেই দেখা যায়।


বাপেক্সের গ্যাসক্ষেত্রে বিদেশিদের না বলুন
নতুন তেলক্ষেত্রটিতে করণীয় কী
ওপরের আলোচনায় একটি তেলক্ষেত্র উন্নয়নের প্রচলিত ধারা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সে ধারা না মেনে ইতিপূর্বে আবিষ্কৃত হরিপুর তেলক্ষেত্রে অপরিপক্ব ও অসম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনায় তেল উৎপাদন করার ফলে তেলক্ষেত্রটি উন্নয়নে যে ব্যর্থতা দেখা গেছে, তা-ও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এসব থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া বিশেষ প্রয়োজন।

বর্তমানে সিলেটে নতুন তেলক্ষেত্রটি উৎপাদন পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে তার উন্নয়ন প্রচলিত ও স্বতঃসিদ্ধ কারিগরি প্রথা অনুযায়ী করা বাঞ্ছনীয়। সে ক্ষেত্রে উৎপাদন কূপটিতে যথাসময়ে রড পাম্প স্থাপন করে তেল উৎপাদনে কৃত্রিম সহায়তা শুরু করতে হবে। উৎপাদনের প্রাথমিক পর্যায় (প্রাইমারি রিকভারি) ও মাধ্যমিক পর্যায়ে (সেকেন্ডারি রিকভারি) প্রচলিত পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করতে হবে। তা না করে শুধু একটিমাত্র কূপ থেকে তার নিজস্ব অপর্যাপ্ত শক্তিনির্ভর উৎপাদনব্যবস্থার দিকে তাকিয়ে থাকলে তেলক্ষেত্রটিও হরিপুর তেলক্ষেত্রের মতো উন্নয়ন ব্যর্থতার সাক্ষ্য বহন করবে।

সম্ভাবনার দিগন্ত
বাংলাদেশে বহু আগে থেকেই যথেষ্ট প্রাকৃতিক গ্যাস আবিষ্কৃত হয়ে আসতে দেখা যায়। প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেল ভূগর্ভে একই পরিবেশে সৃষ্টি হয় ও অবস্থান করে। তাই গ্যাসসমৃদ্ধ দেশগুলোকে তেলসমৃদ্ধও হতে দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের পাশাপাশি তেলের আবিষ্কার সে অর্থে ইতিবাচক বটে।

ভূতত্ত্ববিদদের মতে, সিলেট এলাকায় আরও তেলবাহী স্তর বিদ্যমান এবং অধিক অনুসন্ধান সেগুলোকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে। তেল–গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশি ভূতত্ত্ববিদদের দক্ষতা পরীক্ষিত সত্য বটে।

হরিপুরে যেমন তেলক্ষেত্রটি দেশীয় কর্মীদের সাক্ষাৎ কর্মযজ্ঞের ফলে ঘটেছিল, বর্তমানে নতুন সিলেট তেলক্ষেত্রটিও দেশীয় কর্মীদের হাত ধরে ঘটেছে। এখানে ড্রিলিং কনট্রাক্টর চীনের সিনোপেক কোম্পানি থাকলেও খনন কার্যক্রমটি দেশীয় সিলেট গ্যাস কোম্পানির (এফজিএফসিএল) ভূতত্ত্ববিদের তদারকি ও নির্দেশনায় হয়েছে। বিশেষ করে কূপটি একপর্যায়ে অতি উচ্চ চাপের কারণে ব্লো আউট দুর্ঘটনার সম্মুখীন হলে তাকে সামাল দিয়ে তারপর তেলস্তরটিকে আয়ত্তে নিয়ে আসার কৃতিত্ব দেশীয় ভূবিজ্ঞানীর। এ কথা চীনা সিনোপেক কোম্পানির কর্মীরা স্বীকার করেন।

বাংলাদেশে বর্তমানে বা ইতিপূর্বে আবিষ্কৃত তেলক্ষেত্রগুলোয় প্রতিদিন যে হারে তেল উৎপাদিত হয়েছে, তা অল্প এবং এতে দেশের তেলের চাহিদার কোনো উল্লেখযোগ্য অংশ মেটানো যাবে না। কিন্তু তেলক্ষেত্রগুলো উন্নয়নে যথার্থ ও প্রচলিত পদ্ধতি অবলম্বন করলে এবং তেল অনুসন্ধানে আরও জোরালো কার্যক্রম গ্রহণ করলে, তা ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। যথেষ্ট গ্যাসপ্রাপ্তির দেশে পর্যাপ্ত তেলপ্রাপ্তি সংগত কারণেই আশা করা যায়। এটি বাস্তবায়নের জন্য কূপ খননের মাধ্যমে অনুসন্ধানকাজে জোর দেওয়া এবং প্রাপ্ত তেলক্ষেত্র উন্নয়নে যথার্থ পদ্ধতি অবলম্বন করাই মোক্ষম উপায়।


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর